সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে তরুণ প্রজন্মের প্রতি এক অগাধ প্রত্যাশা পোষণ করে এসেছে জাতি ও রাষ্ট্র। এদের হাত ধরেই জাতির ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়, রচিত হয় উন্নয়নের রূপরেখা। কিন্তু সমকালীন বাস্তবতা যেন সেই আদর্শিক প্রত্যাশাকে কুঞ্চিত করে ফেলে এক নির্মম ব্যঙ্গচিত্রে। যুবসমাজের এক বিরাট অংশ আজ ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছে তাদের আত্মসম্মানবোধ, দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেমের ন্যূনতম প্রকাশ।
সম্প্রতি এক কোম্পানির প্রমোশনাল অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আগত প্রতিনিধিদের অবস্থান ও দর্শক সমাগমের মধ্যে যে নির্মম বৈষম্য লক্ষ করা গেছে, তা আমাদের যুবসমাজের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য এবং মনোভঙ্গির নগ্ন প্রতিচ্ছবি। বাম পাশে অবস্থানরত পুরুষ প্রতিনিধির সামনে ছিল একেবারে জনশূন্যতা। কেউ না দাঁড়িয়ে যেন অদৃশ্য এক অবহেলার ঘেরাটোপে বন্দি করে রেখেছিল তাকে। অপরদিকে, ডান পাশে অবস্থানকারী নারী প্রতিনিধির সামনে ছিল উপচে পড়া ভিড়, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া একদল দর্শক। বাম পাশটি যেন রুক্ষ মরুভূমি—জনশূন্য, সুনসান, নিস্পৃহ। ডান পাশে এক উৎসবমুখর মেলাবাতি—নারী প্রতিনিধি ঘিরে তরুণদের ভিড়, যেন চাঁদের চারপাশে ঘূর্ণায়মান অগণন জোতির্ময় পতঙ্গ। এই বৈপরীত্য নিছক আকর্ষণের পার্থক্য নয়, বরং তা সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক আত্মবিস্মৃততার প্রতিচ্ছবি।
এ দৃশ্য কেবলমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক ব্যাধির ইঙ্গিত। আজকের যুবসমাজের একাংশ—যারা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ব্যস্ত, যারা বাহ্যিক চাকচিক্যে মোহিত, যারা অন্তঃসারশূন্য ‘ভাইরাল’ সংস্কৃতিতে ডুবে—তারা নিজেদের অন্তর থেকে হারিয়ে ফেলেছে দেশ ও জাতির প্রতি প্রকৃত দায়বোধ। যাদের বুকের রক্তে জ্বলে উঠার কথা ছিল শোষিতের পক্ষে, নির্যাতিতের জন্য, তারাই আজ শারীরিক রূপের মোহে বিভোর।
ফিলিস্তিনে জিহাদের কথা বলে যারা মুখে সাহসের কথা আওড়ায়, বাস্তবের মাটিতে তাদের অবস্থান কতটা অসার, তা প্রমাণ হয় এই ঘটনাতেই। একজন পুরুষ প্রতিনিধি যেখানে নিঃসঙ্গ, অবহেলিত, সেখানে নারী প্রতিনিধির কেবল উপস্থিতিই যেন যথেষ্ট উন্মত্ততা সৃষ্টির জন্য। এ কেমন পুরুষত্ব? কেমন বীরত্ব? যেখানে একটি দেশের মুক্তির সংগ্রামের কথা বলার আগে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার ন্যূনতম মানসিক দৃঢ়তাও নেই?
এই সামাজিক চিত্রপট কেবল ব্যক্তির নয়, এটি পুরো একটি প্রজন্মের আত্মিক স্খলনের প্রতিচ্ছবি। চরিত্রে নেই বলিষ্ঠতা, চিন্তায় নেই গভীরতা, এবং আচরণে নেই কোনো নৈতিক দৃঢ়তা। তারা আজ কেবল ভোগের পেছনে ছুটছে, আদর্শ নয়; আকর্ষণের পেছনে মাতোয়ারা, সত্য নয়।
তাই এখনই সময়, যুবসমাজকে নিয়ে নতুন করে ভাবার। তাদের মাঝে আবারও জাগাতে হবে দায়িত্ববোধ, চরিত্রের বলিষ্ঠতা ও আত্মমর্যাদার চেতনা। রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার সবাইকে সমবেত হয়ে এক নবজাগরণ ঘটাতে হবে। একমাত্র তবেই ভবিষ্যতের জন্য গড়ে উঠবে এক সত্যিকারের শক্তিশালী, আদর্শবাদী ও আত্মসচেতন যুবসমাজ।
তরুণদের এই মনোবাসনা যেন সেই তৃষিত পথিকের মত, যে মরীচিকার জল দেখে ছুটে চলে সারাটি জীবন, কিন্তু পান করতে পারে না একফোঁটা তৃপ্তি। এই প্রজন্মের একাংশ আজ নিজেকে বিনোদনের ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করেছে—তারা নিজেদের ভাবেন ‘মুজাহিদ’, অথচ বাস্তবে তারা শুধু একবিংশ শতাব্দীর রূপ-পিপাসু রোবট; কল্পনার জিহাদে বীর।
এক সময় যারা ছিল "পলাশীর প্রান্তর"এর উত্তরাধিকারী, তারা আজ পরিণত হয়েছে স্ক্রল করে যাওয়া আঙুলের খেলোয়াড়ে। এক সময় যাদের কণ্ঠে ছিল বজ্র ধ্বনি, আজ তাদের কণ্ঠে শুধুই কুন্ঠার শব্দ।
তবু আশার প্রদীপ পুরো নিভে যায়নি। এখনই সময় তরুণদের মাঝে গায়রত জাগ্রত করার, তাদের হৃদয়ে ফের প্রবাহিত করার সেই রক্তরাঙা আদর্শ, সেই উন্মেষ যা একদিন সাহসের রূপকথা রচনা করেছিল। এখন দরকার সেই ঝড়, যা ভেঙে ফেলবে নিষ্ক্রিয়তার প্রাচীর, এবং গড়ে তুলবে এক নবতর সমাজ যেখানে যুবক হবে জ্ঞানের দীপ্তির বাহক, দায়িত্বের সৈনিক, এবং আত্মমর্যাদার অভিভাবক।
আমি নই ধ্বংসের অগ্নি, আমি সৃষ্টির বীজ,
আমি যুগ-যুগান্তরের মজলুমদের প্রতিবাদী আর্তনাদ।
অন্যায়ের প্রতিটি চিৎকারে কাঁদে আমার হৃদয়ে,
আমিই সেই মহাকাল, যাহার ধ্বনি শুনি চিরকাল।
জয়গান নয়, আমি উচ্চারণ করি আল্লাহর শপথ—
যেখানে নীরবতা, সেখানে আমি ক্রোধের বিস্ফোরণ,
যেখানে অন্যায়-অত্যাচার, সেখানে আমি জুলফিকার তলোয়ার।
আমি প্রশ্ন করি, আমি বিদীর্ণ করি,
আমি নির্মাণ করি নব উত্থান।